
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে ইলিশের দাম। শখের কারণে খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ছোট আকারের মাছ ছাড়া স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছে বিকল্প কম।
ইলিশের দাম আগেও তুলনামূলক বেশি ছিল, তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে গেছে। স্থানীয় বাজারে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সম্প্রতি একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছে।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘ইলিশ মাছের বাজারমূল্য সংক্রান্ত সমীক্ষা প্রতিবেদন’-এ উল্লেখ করা হয়েছে, দাদন ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব, সিন্ডিকেট, রপ্তানি ও অন্যান্য কারণে জেলেরা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে ভোক্তাদেরকেও চড়া দামে মাছ কিনতে হচ্ছে।
ইলিশের সাপ্লাইচেইন
সমীক্ষা অনুযায়ী, মাছ গ্রাহকের হাতে পৌঁছাতে সাধারণভাবে ৪–৬ ধাপ পার করে। প্রতিটি ধাপে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি হয়। সাপ্লাইচেইনের এই ধাপগুলোই ইলিশের দাম বাড়ানোর মূল কারণ।
সাপ্লাইচেইন ধাপগুলো হলো—
-
জেলে
-
মাছঘাট
-
আড়তদার
-
হোলসেল পাইকার
-
খুচরা বিক্রেতা/দোকানদার
-
ভোক্তা
প্রতিকেজি ইলিশ ধরার খরচ
মাছ ধরার নৌকাভেদে খরচের গড় হিসাব—
-
ছোট নৌকা: ৪৮৩.৮৭ টাকা
-
মাঝারি নৌকা: ৫০৪.০৩ টাকা
-
বড় নৌকা/ফিসিং ট্রলার: ৪৭১.৬৯ টাকা
জেলেদের খরচের সঙ্গে আরও কিছু আনুষঙ্গিক খরচ যোগ হয়। এর মধ্যে রয়েছে উৎপাদকের মুনাফা, আড়ত কমিশন, সংরক্ষণ ব্যয়, ফড়িয়া ও পাইকারের মুনাফা এবং খুচরা ব্যবসায়ীর মুনাফা। ফলে প্রতিকেজি ইলিশের গড় মোট খরচ দাঁড়ায়—
-
ছোট নৌকা: ৮১৩.১০ টাকা
-
মাঝারি নৌকা: ৮৪৬.৭৩ টাকা
-
বড় নৌকা/ফিসিং ট্রলার: ৮২৮.০৪ টাকা
বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ
বাজারে কেজি অনুযায়ী ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮৫০ থেকে ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাদন ব্যবসায়ীরা মাছঘাটে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করেন, যা নিচে নামানো যায় না। এর ফলে দাম বেড়ে যায়।
মূল কারণগুলো হলো—
-
চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যহীনতা
-
মজুদ ও সিন্ডিকেট
-
জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি
-
মাছ ধরার খরচ বৃদ্ধি
-
নদীর নাব্যতা সংকট ও পরিবেশগত কারণ
-
অবৈধ জাল ব্যবহার
-
দাদন ব্যবসা
-
বিকল্প কর্মসংস্থান অভাব
-
নিষিদ্ধ সময় মাছ ধরা
-
মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব
-
রপ্তানি
মূল্য নিয়ন্ত্রণে করণীয়
প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে—
-
জেলেদের সমবায় সমিতি গঠন, যাতে তারা সরাসরি পাইকার বা বড় খুচরা বিক্রেতার কাছে মাছ বিক্রি করতে পারে।
-
সাপ্লাইচেইনের ধাপ কমাতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি ও বাজারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি।
-
মৌসুমে প্রধান শহরগুলোতে সরকারি উদ্যোগে বিশেষ বিপণন কেন্দ্র স্থাপন।
-
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও পরিবহন রুটে আধুনিক কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা।
-
সাপ্লাইচেইনে যুক্ত সবার রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা।
-
বাজারে কৃত্রিম সংকট ও অস্বাভাবিক মুনাফা রোধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি।
-
জেলেদের ন্যায্য বাজারমূল্য নিশ্চিত করতে তথ্য সরবরাহ, ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম এবং প্রশিক্ষণ।
-
ইলিশ সংরক্ষণ ও বিপণনের আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ।
-
ইলিশের আকার অনুযায়ী সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ।
ইলিশ আহরণ ও সরবরাহ
ইলিশের প্রায় ৬০ শতাংশ ধরা হয় সমুদ্র থেকে, ১৫ শতাংশ নদী থেকে এবং ২৫ শতাংশ নদীর মোহনা থেকে। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সরবরাহ কমেছে এবং ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত নদীতে সরবরাহ আগের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে।
দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ পাওয়া যায় ভোলা জেলায়, এরপর বরগুনা, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কক্সবাজার, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী।
0 Comments
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন